জুলাই-অভ্যুত্থান ও ‘নতুন বাংলাদেশ’ আসলেই কি নতুন, নাকি শুধু বোতল বদল?

জুলাই-অভ্যুত্থান ও ‘নতুন বাংলাদেশ’ আসলেই কি নতুন, নাকি শুধু বোতল বদল?
আন্দোলন প্রতিবেদন
সোমবার, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৫ | অনলাইন সংস্করণ
ইউনুস সরকার জুলাই-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির কর্মসূচি পালন করছে। ১ জুলাই থেকে কর্মসূচি শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে ৮ আগস্ট’২৫-এ। কিন্তু ৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ’ দিবস উদযাপন কর্মসূচিটি ‘নাগরিক পার্টি(নাপা- এনসিপি)’র নেতাদের বিরোধিতার কারণে সরকার বাদ দিয়েছে। এখন সরকারি কর্মসচির নাম দেয়া হয়েছে ‘জুলাই স্মৃতি উদযাপন অনুষ্ঠানমালা’। মূলত বুর্জোয়া দলগুলো নির্বাচনী প্রচারণাই চালাচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের অস্ত্রটি যার যার মতো ব্যাখ্যা ও ব্যবহার করে। জুলাই অভ্যুত্থান বর্ষপূর্তিতে ফিরে দেখা যাক বিগত এক বছরে কী ঘটেছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী একদফা কর্মসূচির শুরুতেই কিছু বাম গণতান্ত্রিক সংগঠন-শক্তি ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগণের সমন্বয়ে একটি গণসরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল। তারা রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ক্ষেত্র থেকে ফ্যাসিবাদ নির্মূল কর্মসূচিও হাজির করেছিল। গণতান্ত্রিক শক্তির দুর্বলতার কারণে বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি এবং তৎকালের ‘বিপ্লবী’ ছাত্র নেতারা এই বিপ্লবী কর্মসূচিকে কোনো পাত্তা দেয়নি। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ হত্যার পর আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। তখন এই আন্দোলনে বুর্জোয়া দলগুলোসহ বাম-ডান সবাই সক্রিয় হয়। এই সময় মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা কলকাঠি নাড়তে শুরু করে। তারা এই আন্দোলনে হস্তক্ষেপ/অনুপ্রবেশ করে। সাম্রাজ্যবাদ, দালাল শাসকশ্রেণি এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনে অপসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা, সুশীল তৃতীয় শক্তি মিলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল নিজেদের পকেটস্থ করে এবং ছাত্র নেতৃত্বদের একাংশও, যারা আজ এনসিপি’র প্রধান নেতা, তাদের সাথে একাত্ম হয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের গণ-আকাঙ্ক্ষার সাথে বেঈমানি করে। ৮ আগস্টে এনজিও কর্মকর্তা এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত মানুষ ড.ইউনুসকে ডেকে এনে তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। তার নেতৃত্বে তৃতীয় শক্তির “অন্তর্বর্তী সরকার” গঠিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ ও সেনাবাহিনীর মদদে। যাদের একটা অংশ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় থাকতে ১৫ বছর ধরে মদদ দিয়েছিল এবং অভ্যুত্থানের পর হাসিনা সহ শীর্ষ নেতাদের দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিল। এই সরকার শপথ নিয়েছিল ফ্যাসিাবাদী হাসিনা সরকারের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধানের অধীনে, তাকে মেনে। ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এই সরকারকে স্বাগত জানায় ছাত্র নেতাদের একাংশ সহ আওয়ামী লীগ বাদে বুর্জোয়া সকল দল ও তাদের লেজুড় বামপন্থি নামধারী দলগুলো। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি-জামাতসহ বুর্জোয়া দলগুলোর সাথে ছাত্র নেতারাও একে ‘বিপ্লব’, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, ‘নতুন বাংলাদেশ’ সহ বহু বিশেষণে অভিহিত করেছিল। এখন তারা ভোটের রাজনীতির স্বার্থে ‘দেশ গড়ার’ ভূয়া স্লোগান তুলছে। হাসিনা পতনের পর আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের ঘাসমূল থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত রাজনীতি করার অধিকার হরণ করা হয়নি এবং দ্রুত তাদের তালিকা করা বা তাদের জমি-সম্পত্তি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। অর্থাৎ, শ্রেণি হিসেবে এই ফ্যাসিবাদীদের অস্তিত্ব ও উত্থানের সম্ভাবনা ও শক্তিকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়নি। প্রকৃত বিপ্লবের প্রথম কাজ ছিল সেটাই। কিন্তু এই তথাকথিত বিপ্লববাদীরা গণ-অভ্যুত্থানকে ব্যবহার করেছে নিজেদের ক্ষমতায় আরোহণের জন্য এবং হাসিনা-আওয়ামী পলাতকদের শূন্য জায়গা দখল করবার কাজে। এভাবে তারা গণ-অভ্যুত্থানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে একেবারে শুরুর দিনই। অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরেও শহিদের পূর্ণ তালিকা পর্যন্ত করেনি, আহত-পঙ্গুদের সুচিকিৎসার ভালো কোনো ব্যবস্থা করেনি। কট্টর ফ্যাসিস্টদের উল্লেখযোগ্য বিচার করতে পারেনি। তারা রাষ্ট্রের সংস্কারের মাতম তুলে নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘতর করছে। তথাকথিত বিপ্লববাদীরাও একই সুরে গলা মিলিয়েছে। শাসকশ্রেণি ও সরকারের অন্তর্দ্বন্দ্বে সংস্কার না নির্বাচন, তথাকথিত গণতন্ত্র উদ্ধারের বিতর্ক করছে। বিএনপি সহ যারা আগে নির্বাচন হলে জিতে গদি দখল করতে পারবে তারা ফেব্রয়ারি’২৬-এই নির্বাচন চাইছে। যাদের এ সম্ভাবনা কম (এনসিপি-জামাত) তারা আগে বিচার-সংস্কার, পরে নির্বাচন বা আগে স্থানীয় নির্বাচন পরে জাতীয় নির্বাচন, সংখ্যানুপাতের (পিআর) ধুয়া তুলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ নির্বাচনকে বিলম্বিত করছে। এই দাবিগুলোর মধ্যে শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র-শ্রমজীবী-ছাত্র-তরুণ-সাধারণ মধ্যবিত্ত-আদিবাসী-নারী সহ নিপীড়িত জাতি ও জনগণের কোনো কর্মসূচি নেই। ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকার জনজীবনের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। বিদেশিদের সাথে কোনো দাসত্বমূলক চুক্তি প্রকাশ বা বাতিল করেনি। নতুন করে বন্দর, করিডোর দেয়ার পঁায়তারা করছে। এমনকি ফ্যাসিবাদী হাসিনাকে আশ্রয়দাতা এবং বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারী-আগ্রাসী (সীমান্ত হত্যা, পুশইন, বাণিজ্যে স্থল বন্দরের উপর নিষেধাজ্ঞা– ইত্যাদি) ভারত সরকারের সাথে নতজানু অবস্থান নিয়েছে। জনগণের উপর নির্ভর না করে বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনে কষ্ট বাড়িয়ে তুলছে। ফড়িয়া-ব্যবসায়ী, সিন্ডিকেট-মজুতদার, দুর্নীতিবাজ বহাল তবিয়তে রয়েছে। চাঁদাবাজির মার্কেট, নিয়োগ-বাণিজ্য দখল করেছে যার যেখানে শক্তি বেশি তারা– বিএনপি, জামাত ও নাপা। শ্রমিকদের ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ঘোষণা করেনি। বরং শ্রমিক ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে হত্যা-নির্যাতন করে দমন করছে। কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য দিতে ব্যর্থ সরকার। তাদের উপর পুলিশ-গ্রাম্য মাতব্বরদের দৌরাত্ম বন্ধ করেনি। নারী নির্যাতন বন্ধতো হয়ইনি বরং নারীরা ধর্মবাদীদের বর্ধিত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। খুন-ধর্ষণ-সড়কে হত্যা, ‘মব’ নামের সন্ত্রাস আগের মতোই চলছে। ’৭১-এর খুনী রাজাকার ফ্যাসিস্ট জামাত-শিবিরকে পুনর্বাসন করে ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে। ধর্মবাদীরা নারীর সমানাধিকার প্রশ্নে আস্ফালন করছে, মন্দির মাজার আক্রান্ত হচ্ছে। এ সব প্রশ্নে সরকার নির্বিকার, নতজানু ভূমিকা পালন করছে। সরকারের গণবিরোিধতাকে পুঁজি করে এনসিপি নতুন বক্তব্য নিয়ে মাঠে নেমে জনগণকে নতুন করে প্রতারণা করছে। তারা বলছে ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদ হয়নি, নতুন সংবিধান, নতুন বন্দোবস্ত, জুলাই সনদ, দেশ গড়া, পুনর্গঠন– ইত্যাদি বুলিতে নির্বাচনী প্রচারে মাঠ গরম করছে। অথচ তারা এখনও এ সরকারের অংশীদার। হাসিনা সরকারের পতনের ৯ মাস পর তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি তুলেছিল, কারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাতে অংশ নিতে না পারে সে ব্যবস্থা করে শূন্য স্থান দখল করা। তারা দুর্নীতি-চাঁদাবাজ, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করলেও ’৭১-এর ঘাতক জামাত-শিবিরের সভাগুলোতে সম্মানের আসন অলংকৃত করছে। অতীতে দুর্নীতি, চাঁদাবাজী বন্ধের স্লোগান দিয়ে জিয়া-এরশাদ-হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তা বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে। রিফাইন আওয়ামী লীগ বা ভিন্নভাবে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টাও করছে সাম্রাজ্যবাদ, ভারত ও তাদের দালালরা। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকার বা নির্বাচিত সরকার যে-ই ক্ষমতায় থাকুক বা আসুক তাতে ‘নতুন বাংলাদেশ’ হবে না। ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে তারা চলমান ব্যবস্থাকেই চুনকাম করে আবার একই খেলা খেলছে, যা তারা খেলেছিল ’৭১, ’৭৫, ’৯০ সালেও। এগুলো হলো জনগণকে প্রতারণা করে শুধু বোতল বদল করা বা নতুন বোতলে পুরোনো মদ পরিবেশন। জনগণ যে তিমিরে ছিলেন সেখানেই আছেন, আগামীতেও থাকবেন, যতদিন না বিদ্যমান ব্যবস্থার রক্ষাকর্তাদের শোষণ-শাসনের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে। সর্বস্তরের নিপীড়িত জনগণকে নিজেদের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাওবাদের আদর্শে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে, শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করতে হবে।
© সর্বস্বত্ব স্বত্বাধিকার সংরক্ষিত
জুলাই-অভ্যুত্থান ও ‘নতুন বাংলাদেশ’ আসলেই কি নতুন, নাকি শুধু বোতল বদল?
ইউনুস সরকার জুলাই-অভ্যুত্থানের বর্ষপূর্তির কর্মসূচি পালন করছে। ১ জুলাই থেকে কর্মসূচি শুরু হয়ে শেষ হচ্ছে ৮ আগস্ট’২৫-এ। কিন্তু ৮ আগস্ট ‘নতুন বাংলাদেশ’ দিবস উদযাপন কর্মসূচিটি ‘নাগরিক পার্টি(নাপা- এনসিপি)’র নেতাদের বিরোধিতার কারণে সরকার বাদ দিয়েছে। এখন সরকারি কর্মসচির নাম দেয়া হয়েছে ‘জুলাই স্মৃতি উদযাপন অনুষ্ঠানমালা’। মূলত বুর্জোয়া দলগুলো নির্বাচনী প্রচারণাই চালাচ্ছে জুলাই অভ্যুত্থানের অস্ত্রটি যার যার মতো ব্যাখ্যা ও ব্যবহার করে। জুলাই অভ্যুত্থান বর্ষপূর্তিতে ফিরে দেখা যাক বিগত এক বছরে কী ঘটেছে। ফ্যাসিবাদবিরোধী একদফা কর্মসূচির শুরুতেই কিছু বাম গণতান্ত্রিক সংগঠন-শক্তি ফ্যাসিবাদবিরোধী রাজনৈতিক শক্তি এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগণের সমন্বয়ে একটি গণসরকার গঠনের আহ্বান জানিয়েছিল। তারা রাষ্ট্র ও সমাজের সকল ক্ষেত্র থেকে ফ্যাসিবাদ নির্মূল কর্মসূচিও হাজির করেছিল। গণতান্ত্রিক শক্তির দুর্বলতার কারণে বুর্জোয়া শাসকশ্রেণি এবং তৎকালের ‘বিপ্লবী’ ছাত্র নেতারা এই বিপ্লবী কর্মসূচিকে কোনো পাত্তা দেয়নি। ১৬ জুলাই আবু সাঈদ হত্যার পর আন্দোলন নতুন মোড় নেয়। তখন এই আন্দোলনে বুর্জোয়া দলগুলোসহ বাম-ডান সবাই সক্রিয় হয়। এই সময় মার্কিন ও ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীরা কলকাঠি নাড়তে শুরু করে। তারা এই আন্দোলনে হস্তক্ষেপ/অনুপ্রবেশ করে। সাম্রাজ্যবাদ, দালাল শাসকশ্রেণি এবং সেনাবাহিনীর সমর্থনে অপসরপ্রাপ্ত সেনাকর্মকর্তা, সুশীল তৃতীয় শক্তি মিলে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের ফসল নিজেদের পকেটস্থ করে এবং ছাত্র নেতৃত্বদের একাংশও, যারা আজ এনসিপি’র প্রধান নেতা, তাদের সাথে একাত্ম হয়ে জুলাই অভ্যুত্থানের গণ-আকাঙ্ক্ষার সাথে বেঈমানি করে। ৮ আগস্টে এনজিও কর্মকর্তা এবং পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদের বিশ্বস্ত মানুষ ড.ইউনুসকে ডেকে এনে তার হাতে ক্ষমতা তুলে দেয়। তার নেতৃত্বে তৃতীয় শক্তির “অন্তর্বর্তী সরকার” গঠিত হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদ ও সেনাবাহিনীর মদদে। যাদের একটা অংশ হাসিনার ফ্যাসিবাদকে ক্ষমতায় থাকতে ১৫ বছর ধরে মদদ দিয়েছিল এবং অভ্যুত্থানের পর হাসিনা সহ শীর্ষ নেতাদের দেশ থেকে পালিয়ে যেতে সহযোগিতা করেছিল। এই সরকার শপথ নিয়েছিল ফ্যাসিাবাদী হাসিনা সরকারের রাষ্ট্রপতি ও সংবিধানের অধীনে, তাকে মেনে। ৮ আগস্ট বঙ্গভবনে শপথ অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে এই সরকারকে স্বাগত জানায় ছাত্র নেতাদের একাংশ সহ আওয়ামী লীগ বাদে বুর্জোয়া সকল দল ও তাদের লেজুড় বামপন্থি নামধারী দলগুলো। জুলাই অভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার, বিএনপি-জামাতসহ বুর্জোয়া দলগুলোর সাথে ছাত্র নেতারাও একে ‘বিপ্লব’, ‘দ্বিতীয় স্বাধীনতা’, ‘নতুন বাংলাদেশ’ সহ বহু বিশেষণে অভিহিত করেছিল। এখন তারা ভোটের রাজনীতির স্বার্থে ‘দেশ গড়ার’ ভূয়া স্লোগান তুলছে। হাসিনা পতনের পর আওয়ামী ফ্যাসিবাদীদের ঘাসমূল থেকে সর্বোচ্চ স্তর পর্যন্ত রাজনীতি করার অধিকার হরণ করা হয়নি এবং দ্রুত তাদের তালিকা করা বা তাদের জমি-সম্পত্তি, ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান বাজেয়াপ্ত করা হয়নি। অর্থাৎ, শ্রেণি হিসেবে এই ফ্যাসিবাদীদের অস্তিত্ব ও উত্থানের সম্ভাবনা ও শক্তিকে গুঁড়িয়ে দেয়া হয়নি। প্রকৃত বিপ্লবের প্রথম কাজ ছিল সেটাই। কিন্তু এই তথাকথিত বিপ্লববাদীরা গণ-অভ্যুত্থানকে ব্যবহার করেছে নিজেদের ক্ষমতায় আরোহণের জন্য এবং হাসিনা-আওয়ামী পলাতকদের শূন্য জায়গা দখল করবার কাজে। এভাবে তারা গণ-অভ্যুত্থানের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছে একেবারে শুরুর দিনই। অন্তর্বর্তী সরকার জুলাই অভ্যুত্থানের এক বছরেও শহিদের পূর্ণ তালিকা পর্যন্ত করেনি, আহত-পঙ্গুদের সুচিকিৎসার ভালো কোনো ব্যবস্থা করেনি। কট্টর ফ্যাসিস্টদের উল্লেখযোগ্য বিচার করতে পারেনি। তারা রাষ্ট্রের সংস্কারের মাতম তুলে নিজেদের ক্ষমতা দীর্ঘতর করছে। তথাকথিত বিপ্লববাদীরাও একই সুরে গলা মিলিয়েছে। শাসকশ্রেণি ও সরকারের অন্তর্দ্বন্দ্বে সংস্কার না নির্বাচন, তথাকথিত গণতন্ত্র উদ্ধারের বিতর্ক করছে। বিএনপি সহ যারা আগে নির্বাচন হলে জিতে গদি দখল করতে পারবে তারা ফেব্রয়ারি’২৬-এই নির্বাচন চাইছে। যাদের এ সম্ভাবনা কম (এনসিপি-জামাত) তারা আগে বিচার-সংস্কার, পরে নির্বাচন বা আগে স্থানীয় নির্বাচন পরে জাতীয় নির্বাচন, সংখ্যানুপাতের (পিআর) ধুয়া তুলে বুর্জোয়া গণতন্ত্রের প্রধান স্তম্ভ নির্বাচনকে বিলম্বিত করছে। এই দাবিগুলোর মধ্যে শ্রমিক-কৃষক-দরিদ্র-শ্রমজীবী-ছাত্র-তরুণ-সাধারণ মধ্যবিত্ত-আদিবাসী-নারী সহ নিপীড়িত জাতি ও জনগণের কোনো কর্মসূচি নেই। ফলে জুলাই অভ্যুত্থানের পর গঠিত সরকার জনজীবনের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেনি। বিদেশিদের সাথে কোনো দাসত্বমূলক চুক্তি প্রকাশ বা বাতিল করেনি। নতুন করে বন্দর, করিডোর দেয়ার পঁায়তারা করছে। এমনকি ফ্যাসিবাদী হাসিনাকে আশ্রয়দাতা এবং বাংলাদেশ বিরোধী ষড়যন্ত্রকারী-আগ্রাসী (সীমান্ত হত্যা, পুশইন, বাণিজ্যে স্থল বন্দরের উপর নিষেধাজ্ঞা– ইত্যাদি) ভারত সরকারের সাথে নতজানু অবস্থান নিয়েছে। জনগণের উপর নির্ভর না করে বিদেশিদের কাছে ধর্ণা দিচ্ছে। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি জনজীবনে কষ্ট বাড়িয়ে তুলছে। ফড়িয়া-ব্যবসায়ী, সিন্ডিকেট-মজুতদার, দুর্নীতিবাজ বহাল তবিয়তে রয়েছে। চাঁদাবাজির মার্কেট, নিয়োগ-বাণিজ্য দখল করেছে যার যেখানে শক্তি বেশি তারা– বিএনপি, জামাত ও নাপা। শ্রমিকদের ন্যূনতম জাতীয় মজুরি ঘোষণা করেনি। বরং শ্রমিক ও সংখ্যালঘু জাতিসত্তার এবং বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার জনগণের ন্যায়সঙ্গত আন্দোলনকে হত্যা-নির্যাতন করে দমন করছে। কৃষকদের ফসলের ন্যায্য মূল্য দিতে ব্যর্থ সরকার। তাদের উপর পুলিশ-গ্রাম্য মাতব্বরদের দৌরাত্ম বন্ধ করেনি। নারী নির্যাতন বন্ধতো হয়ইনি বরং নারীরা ধর্মবাদীদের বর্ধিত নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। খুন-ধর্ষণ-সড়কে হত্যা, ‘মব’ নামের সন্ত্রাস আগের মতোই চলছে। ’৭১-এর খুনী রাজাকার ফ্যাসিস্ট জামাত-শিবিরকে পুনর্বাসন করে ধর্মবাদী ফ্যাসিবাদের উত্থানের পথ প্রশস্ত করেছে। ধর্মবাদীরা নারীর সমানাধিকার প্রশ্নে আস্ফালন করছে, মন্দির মাজার আক্রান্ত হচ্ছে। এ সব প্রশ্নে সরকার নির্বিকার, নতজানু ভূমিকা পালন করছে। সরকারের গণবিরোিধতাকে পুঁজি করে এনসিপি নতুন বক্তব্য নিয়ে মাঠে নেমে জনগণকে নতুন করে প্রতারণা করছে। তারা বলছে ফ্যাসিবাদ উচ্ছেদ হয়নি, নতুন সংবিধান, নতুন বন্দোবস্ত, জুলাই সনদ, দেশ গড়া, পুনর্গঠন– ইত্যাদি বুলিতে নির্বাচনী প্রচারে মাঠ গরম করছে। অথচ তারা এখনও এ সরকারের অংশীদার। হাসিনা সরকারের পতনের ৯ মাস পর তারা আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবি তুলেছিল, কারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ যাতে অংশ নিতে না পারে সে ব্যবস্থা করে শূন্য স্থান দখল করা। তারা দুর্নীতি-চাঁদাবাজ, আওয়ামী ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিষোদগার করলেও ’৭১-এর ঘাতক জামাত-শিবিরের সভাগুলোতে সম্মানের আসন অলংকৃত করছে। অতীতে দুর্নীতি, চাঁদাবাজী বন্ধের স্লোগান দিয়ে জিয়া-এরশাদ-হাসিনা ক্ষমতায় এলেও তা বন্ধ হয়নি। বরং বেড়েছে। রিফাইন আওয়ামী লীগ বা ভিন্নভাবে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের চেষ্টাও করছে সাম্রাজ্যবাদ, ভারত ও তাদের দালালরা। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকার বা নির্বাচিত সরকার যে-ই ক্ষমতায় থাকুক বা আসুক তাতে ‘নতুন বাংলাদেশ’ হবে না। ফ্যাসিবাদ বিরোধী গণ-আন্দোলন ও অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষাকে পদদলিত করে তারা চলমান ব্যবস্থাকেই চুনকাম করে আবার একই খেলা খেলছে, যা তারা খেলেছিল ’৭১, ’৭৫, ’৯০ সালেও। এগুলো হলো জনগণকে প্রতারণা করে শুধু বোতল বদল করা বা নতুন বোতলে পুরোনো মদ পরিবেশন। জনগণ যে তিমিরে ছিলেন সেখানেই আছেন, আগামীতেও থাকবেন, যতদিন না বিদ্যমান ব্যবস্থার রক্ষাকর্তাদের শোষণ-শাসনের ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করা যাচ্ছে। সর্বস্তরের নিপীড়িত জনগণকে নিজেদের মুক্তির জন্য সমাজতন্ত্র-কমিউনিজম ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে মাওবাদের আদর্শে শ্রমিকশ্রেণির নেতৃত্বে, শ্রমিক-কৃষক মৈত্রীর ভিত্তিতে ঐক্যবদ্ধ হয়ে নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লব সংগঠিত করতে হবে।
আরও খবর
- শনি
- রোব
- সোম
- মঙ্গল
- বুধ
- বৃহ
- শুক্র